Wednesday, September 19, 2012

ভোজ কয় যাহারে॥

ভোজ নিয়ে দু-কলম লিখতেই হলো প্রবাসে আসা ইস্তক যে রেটে বিয়ে, অন্নপ্রাশন মায় শ্রাদ্ধের ভোজও মিস হচ্ছে, তাতে আর থাকা গেল না এই ভোজ মিস্‌-এর যত খবর কানে আসে কিরকম একটা হাত নিশপিশ করে, রাগ হয় আর এই একাবোকা জীবনে রাগ হলে কি আর করা - ইন্টারনেটাং শরণং গচ্ছামি সেদিন ফেসবুকে উঁকিঝুঁকি দিয়ে বা ইউটিউব- দর্দ্ভরা গান শুনে মনের জ্বালা মিটল না তো কোনো একটা দাদুসঙ্গীত এর লিরিক দেখতে গিয়ে ভাষা প্রযুক্তি গবেষণা পরিষদের রবীন্দ্র রচনাবলীর সাইটটিতে যখন উঁকিঝুঁকি মারছি তখন বিদ্যুতঝিলিকের মত একটা আইডিয়া মাথায় এলো মাথাটা ঠান্ডা করার একটু দাদুর লেখা ছোটোগল্পের পাড়াটা ঘুরে এলে হয়না? যেমন ভাবা তেমনি কাজ কিন্তু, অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকায়ে যায় খুললাম তো খুললাম প্রথমেই 'যজ্ঞেশ্বরের যজ্ঞ' সেভেন-এইটে পরা এই ছোটোগল্পটির বিষয়বস্তু পুরো ভুলে মেরে দিয়েছিলাম কিন্তু নামটা চেনা চেনা ঠেকতেই দিলাম মাউসের কোপ মেরে ব্যাস, ‘ভোজফিরে এল মূর্তিমান বিভীষিকা হয়ে অবশ্য আপনারা যারা আমার মত নন, মানে খাবারের নাম শুনলে/দেখলে বা খাবারের গন্ধ পেলেই খাবারের জন্য হাঁকুপাকু করে ওঠেন না, তারা অবশ্যই গল্পটিতে একবার ঢুঁ মেরে আস্তে পারেন এই হল লিঙ্কদাদুর লেখা পড়ে উপবাসী মন শান্ত হয়নি এমন মানুষ খুঁজলে বিরল বলব না, তবে খুঁজে পেলে তার সাথে আমি কথা বলব না, এই যা
রবি ঠাকুর তো ফিরিয়ে দিলেন স্কুলজীবনে। রাগটা দ্বিগুন বেগে প্রত্যাবর্তনের হুমকি দিলেও আবারও পড়ে ফেললাম গল্পটা। মেয়ের বাপের অসহায়তা, ছেলের বাপের উন্নাসিকতা, বরযাত্রীদের অসভ্যতা বা জামাই বাবাজীর ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হওয়া এসব ছাড়িয়েও যেটা মনে বসে গিয়েছিল সেটা হল হ্যাজাকের আলো, আটচালা, বৃষ্টি আর তার মধ্যে পাত পেড়ে খাওয়া। কি রোমান্টিক, কি রোমান্টিক! (ডায়েটপন্থীরা ভাবুন পড়াটা এখানেই শেষ করবেন কিনা, আর আমি বরং লেখাটা নিয়ে এগোই)iবাকি আর কিছুর কথা জানিনা, কিন্তু মাটিতে পাত পেড়ে খাওয়াটা একঘর। আমার বাবা-কাকারা ছোটবেলায় এরকম কিছু ভোজ খেয়েছেন, কিন্তু আমরা নৈব নৈব চ। এই অব্দি এসে ভাবতে বসলাম আমার ছোটবেলায়ও তো ভোজভাতে এমন কিছু জিনিস ছিলো যা এখন আর দেখা যায় না। দেখি একটা ফর্দ করা যাক
ফর্দ করতে বসে প্রথমেই যে জিনিসটা মাথায় আসে সেটা হলো মাটির ভাঁড়। অবশ্য শুধু মাটির ভাঁড় বললে কিছুই বোঝানো যায় না। তার সাথে আরো অনেক কিছু বলতে হবে। যেমন ধরুন, প্যান্ডেলটা কোথায় হতো? হ্যাঁ মশাই, প্যান্ডেলই। তখন তো আর আজকালকার মতোঅনুষ্ঠানবাড়ীছিলো না, নিজেদের বাড়ীর ছাদ না হলে আশেপাশে কোনো একচিলতে ফাঁকা যায়গায় বাঁশ আর মোটা কাপড়ে তৈরী প্যান্ডেলেই মোধো থেকে মধুসূদন সকলেই খাওয়াদাওয়া সারত। আর ছাদে না হলে কেলো বাড়ত বই কমত না। অসমান মাটির ওপর নড়বড়ে একজোড়া ফোল্ডিং পায়া, তার ওপর একখানা কাঠের তক্তা কোনরকমে বসান। সেই টলটলায়মান সিস্টেমটির ওপর যে কিকরে মাথাভারী মাটির ভাঁড় ব্যালেন্স করে থাকত তা সে রাধামাধবই জানেন। অবশ্য, গা ঘেষাঘেষি করে পেটপূজোয় বসা জনগনের হৃৎকম্প বাড়াত আর একটি জিনিসও। যদিও উদ্দেশ্য তার মহানই থাকত, কিন্তু ওই বাঁশের খাঁচার অস্থায়ী প্যান্ডেল, সে যাবে কোথায়? খাওয়ার পরিশ্রমে শ্রান্ত তনু জুড়ানোর জন্য ব্যাবস্থা থাকতো ফ্যানের। সে ঝুলত মাথার ওপর, তবে ওই বাঁশ থেকেই। ফল? ফল ছিল গোটা প্যান্ডেলের কম্পন। আর সেইকাঁপাকাঁপিপরিবেশকে আর মোহময় করত দু একটি নিতান্তই বালক/বালিকা। তাদের না পা পৌছত মাটিতে, না হাত ভাঁড় অব্দি। কিন্তু মোহময়ী খাদ্যবস্তু যখন ঝালের মাধ্যমে জিহ্বার স্বাদকোরকগুলিকে নিতান্ত পীড়ন করত তখন সে সব ভুলে বাড়াত সেই ভাঁড়ের দিকে হাত। আর সেই মাহেন্দ্রক্ষণে সূচনা হত জল-টল পড়ে এক ক্যাডাভ্যারাস্কান্ডের
উৎসঃ ইন্টারনেট
এতো গেলো পানীয়র ব্যাপার। এবার আসি সলিড খাবারদাবারের কথায়। এইসব খাবার দিত কোথায়? ঠিক ধরেছেন, ‘শালপাতায়। অবশ্য ছবিতে যেরকম দেখাচ্ছে প্রথমদিকে এত সুবিধাজনক অবস্থায় এনাকে ঠিক পাওয়া যেত না। ইনি তখন থাকতেন কিছুটা মুক্তকচ্ছ অবস্থায়, মানে ওই কানাউঁচু গল্পটা ছিলনা। আর সেসব পাতায় থাকত অজস্র ছ্যাঁদা। সেই ছ্যাঁদা গলে মূল্যবান খাদ্যবস্তুর পঞ্চত্বপ্রাপ্তি আটকাতে তলায় আরেকটা করে পাতা দেওয়া হতো। ডাবল কভার আরকি। কিছু বেয়ারা ভাতের কণা যে ঝোলঝাল সমন্বিত হয়ে দুটি পাতার মাঝখানে ঠাঁই নিত না এমনটা বলা যায় না, তবে নিমন্ত্রিত মশাইরা এই তুচ্ছ ব্যাপারটা খুব একটা পাত্তা দিতেন না। তারা বরং থালার ওপরের বিপুল খাদ্যসম্ভার ভুলে মাঝেসাঝে ওপরের থালার ছোট ছোট পাতার ফাঁকে আটকে যাওয়া খাবারের কণা বের করতে প্রচন্ড উৎসাহী হয়ে পরতেন। সে সাফল্য তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করার আগেই যে ব্যাপারটা ঘটতো সেটা আরো মারাত্মক। বেয়ারা খাবারকে সোজা করতে গিয়ে উনি তো স্লো হয়ে পরেছেন, এতক্ষণে ডাল দিয়ে চাড্ডি ভাত মাখিয়ে খাচ্ছেন। এমন সময় প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে পাতে পড়ল চাটনি। পড়ল তো পড়ল, কিন্তু তাকে পাতার উপত্যকা বেয়ে, অন্যান্য খাদ্যবস্তুর ফাঁক গলে, ডালে এসে মিশতে কে বলেছিল রে বাবা! কাজেই পাতার কল্যানে, ডাল যেমন হয়ে উঠত টক বা মিষ্টি তেমনি মাছ হয়ত বা হয়ে উঠত দই-মাছ। বিবর্তনের ফলে শালপাতা হোলো কানাউঁচু, তাতে কাঠির বদলে লাগলো সুতো আর ঝাড়াই বাছাই করা পাতা হয়ে উঠল প্রায় ছিদ্রবিহীন। তাতে খাওয়াটা একটুসভ্যভব্যহোলো বটে, তবে নেমন্তন্ন খাওয়ার রোমাঞ্চটা যে দশগুণ কমে গেল সেটা বলাই বাহুল্য। আর আজকের থার্মোকল বা বোনচায়নার যুগে - উও বাত কাঁহা?
এইবেলা আমার শালপাতা প্রেম নিয়ে দু-একটা কথা সেরে রাখি। নেমন্তন্ন হোক বা বাড়িতে খাওয়া 'শালপাতায় খাব' – এই ব্যপারটা আমার বেজায় ভালো লাগতো। বাড়িতে অবশ্য, বুঝতাম না কেন, শালপাতা ব্যাপারটাকে খুব একটা এনকারেজ করা হত না। ব্যাপারটা সুবিধেজনক বলেই তো আমার ধারণা। মাজামাজির ঝামেলা কিছুটা হলেও তো কমে। যাই হোক, রোজকার থোড়-বড়ি-খাড়ার দিনে যখন শুনতে পেতাম কাজের দিদা বলছে, “ বউমা, বড়বিটির ব্যাটাটার শরীরটা ঠিক যেছে না। সামনের হাটবারের পর একটু লাতির কাছে যাব। তোমার কষ্ট হবে না তো মা দুদিন চালিয়ে নিতে?” তখন মায়ের বা কাজের দিদার নাতি কারও কষ্টেই ঠিক দুঃখ পেতাম না। মায়ের কষ্টের কিছুটা সুরাহা করতে বাবা ঠিক শালপাতা নিয়ে হাজির হতো। আর আমায় পায় কে, আনন্দে দু-গ্রাস ভাতও বেশি খেয়ে ফেলতাম। আর একটা ঘটনার কথা এখানে না বললেই নয়। প্রাইমারী স্কুলে পড়াকালীন একবার এক সম্পর্কিত দাদু কাম শিক্ষক আমাদের শীতকালে চড়ুইভাতি করাতে নিয়ে গিয়েছিলেন গ্রামের ঠিক বাইরেটিতেই। যথাসময়ে সব শেষ হলে সবাই রওনা দিলাম হেঁটে বাড়ির পথে। আমার চোখ ছিল বেঁচে থাকা শালপাতাকটির ওপর। আহা, কয়েকটা শালপাতা বাড়ি নিয়ে গেলে মা কি আর আমায় ওই শালপাতাকটিতে কয়েকদিন খেতে দেবেন না? বেশ ফুরফুরে মনে শালপাতা দুলিয়ে দুলিয়ে হাঁটছিলাম, এমন সময় তাল কাটল কয়েকটি মেঠো কাচ্চাবাচ্ছা। আমায় দেখিয়ে বলে কিনা, “একে নির্ঘাত খেতে দেয়নি, তাই দুটো শালপাতা ধরিয়ে দিয়েছেকি লজ্জা কি লজ্জা। প্রাণে ধরে দিলাম ফেলে সাধের শালপাতা
আরেকটা বিশাল পরিবর্তন হয়েছে খাওয়া বা খাওয়ানোর পদ্ধতিতে। এখন হয়বাফেনা হয় টাই পরা ক্যাটারার। আর তখন ভোজে, পাড়া বা ক্লাবের ছেলেরাই থাকত পরিবেশনের দায়িত্বে। খাওয়ানো শুরু হয়ে গেলে তারাই আসরের কর্তা। গৃহকর্তাকে শুধু মাঝে মাঝে দু একজন সর্দার গোছের পরিবেশনকারীর কানে কানে, “বাচ্ছাদের একটু সামলে সামলে দিস। ওরা নষ্ট করে প্রচুর।“ – এই ধরনের দু একটা কথা বলা ছাড়া আর কিছু ভাবতে হতো না। আর তারাও জায়গা বুঝে মোলায়েম হাসি সহযোগেদাদা আর একটু দিইবাবৌদি কিন্তু ঠিক করে খাচ্ছেন নাবা একটু চোখ পাকিয়েবিল্টু, মাছটা শেষ করতে হবে কিন্তুবলে ঠিক কাজটা উদ্ধার করে দিতো। পোষাকের মধ্যে আর যাই থাক না কেন, কটিদেশে গামছা একখানি ঠিকই ঝুলত তাদের। আর পারিশ্রমিক বলতে ছিল দিনকয়েক পরে একটু কবজি ডুবিয়ে খাওয়া। কচি বয়সে এদের অবশ্য বেশ ভয়ই পেতাম। এরা তুষ্ট হলে তবেই না ঠিকঠাকভোজজুটবে কপালে। আরো কারণ ছিলো অবশ্য। যেমন আমাকে এরা কোনদিনই ভোজে জল পরিবেশনকারীদেরএলিটদলে রাখার যোগ্য মনে করেনি। দ্বিতীয় কারনটা আরও মর্মান্তিক। কোনদিনই আমার একটা করে পান আর একটা করে আইসক্রিমে পোষাত না। আর এরা আমায় সেই সু্যোগটাই দিতো না। অগত্যা মা-বাবার কাছে ভালো ছেলে হয়ে থাকার কড়ারে এডিশনাল পান বা আইসক্রিম হাতাতে হতো। এখনকার এইনা চাহিলে যারে পাওয়া যায়মার্কা ভোজে (মানেবাফেতে) কি আর এই রোমাঞ্চ পাওয়া যায়? জানিনা
যাকগে, অনেক বকে ফেললাম। নটে গাছখানা এবার মুড়োই। স্বর্গীয় জগ্জিৎ সিংহের গাওয়া এই গানখানি শুনতে শুনতে আপনারাও একটু ছেলেবেলাটাকে ফিরে দেখুন আর আমার সাথে শেয়ার করুন সেই গল্পকথা। ভালো থাকুন সকলে